রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫
Natun Kagoj
শিরোনাম
  • সংস্কারবিরোধী দেখানোর চেষ্টা চলছে পরিকল্পিতভাবে: মির্জা ফখরুল ইউএস বাংলার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জব্দকৃত জমি বিক্রির অভিযোগে ফের বিতর্কে তারিক সিদ্দিক নতুন প্রস্তাবে স্থবিরতা, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিয়ে উদ্বেগ: ফখরুল যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর খামেনির জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার কোনো সুযোগ নেই: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শেষের নাটকে মোস্তাফিজের জাদু, শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে সিরিজে বাঁচল বাংলাদেশ এশিয়ান কাপে দুর্দান্ত আগমন, তুর্কমেনিস্তানকে গোল বন্যায় ভাসাল বাংলাদেশ নারী দল পবিত্র আশুরায় ঢাকায় ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিল শুরু পবিত্র আশুরা জুলুমের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা জোগাবে: প্রধান উপদেষ্টা
  • ভূমি দখল থেকে সোনা চোরাচালান:

    ইউএস বাংলার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

    ইউএস বাংলার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়
    গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

    ইউএস বাংলা গ্রুপ, বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে এর বিরুদ্ধে কৃষি জমি অবৈধভাবে দখল, ভ্যাট ফাঁকি, সোনা চোরাচালান, যাত্রী প্রতারণা এবং সাংবাদিক লাঞ্ছনার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ দেশের অর্থনীতি, কৃষি খাত এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    কৃষি জমি দখল ও সাংবাদিক নির্যাতন

    নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার পাচঁরুখী গ্রামে ইউএস বাংলা গ্রুপের বিরুদ্ধে কৃষি জমি অবৈধভাবে দখলের অভিযোগ উঠেছে। গত ২৯ জানুয়ারি ২০২২, শনিবার বিকেলে এই ঘটনা ঘটে। স্থানীয় কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, ইউএস বাংলা গ্রুপ রূপগঞ্জের কাঞ্চন এলাকায় তাদের প্রকল্পের জন্য পাচঁরুখী গ্রামের প্রায় ১০০ একর জমি জোরপূর্বক দখলের চেষ্টা করছে। এই জমির মধ্যে ৬০০ পরিবারের পৈত্রিক ও বৈধ মালিকানাধীন জমি রয়েছে। কোম্পানিটি আংশিক জমি ক্রয় করে ক্ষমতার দাপটে পুরো এলাকায় বালু ভরাট করে কৃষি জমির প্রকৃতি নষ্ট করছে। এতে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং পার্শ্ববর্তী খাল থেকে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় কৃষক নয়ন ফকির অভিযোগ করেন, কোম্পানির লোকজন জমির চারপাশে বালু ভরাট করে এবং খাল বন্ধ করে দিয়ে আমাদের কৃষি কাজ অসম্ভব করে তুলেছে। আমরা বাধা দিতে গেলে তারা আমাদের হুমকি দেয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে পাচঁরুখীর ৫০০ জনেরও বেশি বাসিন্দা গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে জেলা প্রশাসনের কাছে জমি দখল বন্ধের আবেদন জানিয়েছেন। এই ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দৈনিক ইনকিলাবের আড়াইহাজার প্রতিনিধি আল আমিন কোম্পানির নিয়োজিত লোকজনের হাতে লাঞ্ছিত হন। তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করা হয়, এবং পরে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ঘটনায় আল আমিন আড়াইহাজার থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

    ভ্যাট ফাঁকি ও অর্থ পাচার

    ইউএস বাংলা গ্রুপের ১২টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকি, বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহার এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও কাস্টমস বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গ্রুপটি সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আত্মসাৎ করেছে। এনবিআরের কর্মকর্তা জানান, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটনে অডিট চলছে। মাঠ পর্যায়ে ভ্যাট গোয়েন্দারাও কাজ করছে। ইউএস বাংলা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে:

    * ইউএস বাংলা অ্যাসেটস লিমিটেড

    * ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস

    * গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

    * ইউএস বাংলা মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল

    * ইউএস বাংলা লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ

    * ইউএস বাংলা ফুটওয়্যার

    * ইউএস বাংলা হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ

    * ইউএসবি এক্সপ্রেস (কুরিয়ার সার্ভিস)

    * ইউএস বাংলা ফুডস

    * ইউএস বাংলা ফ্যাশনস

    * ইউএস বাংলা অটোমোবাইলস

    * ইউএস বাংলা রিসোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম

    ইউএস বাংলা অ্যাসেটস লিমিটেডের ‘পূর্বাচল আমেরিকান সিটি’, ‘ইস্ট আমেরিকান সিটি’ এবং ‘হলিডে হোমস কুয়াকাটা’ প্রকল্পে দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট ফাঁকি চলছে বলে অভিযোগ। কাস্টমস সূত্র জানায়, ইউএস বাংলা লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহার করে শুল্কমুক্ত পণ্য কালোবাজারে বিক্রি করছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে জরিমানা করা হয়েছে এবং তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের বিরুদ্ধে টিকিট বিক্রিতে প্রাপ্য ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। গ্রিন ইউনিভার্সিটি ও মেডিক্যাল কলেজের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে তদন্তের মুখোমুখি। এছাড়া, ইউএসবি এক্সপ্রেস কুরিয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে ভ্যাট চালান ছাড়া পণ্য পরিবহনের অভিযোগ উঠেছে, যার জন্য ২০১৯ সালে জরিমানা করা হয়েছিল।

    ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের বিরুদ্ধে সোনা চোরাচালানের একাধিক ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা কাস্টম হাউস ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এয়ারলাইনসটির ফ্লাইট থেকে শত কোটি টাকার সোনা উদ্ধার হয়েছে। উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো হলো:

    * ২০২১, ৯ ফেব্রুয়ারি: দুবাই থেকে আসা ফ্লাইটে ৭ কেজি সোনা উদ্ধার, ৮ জন কর্মী আটক। মূল্য প্রায় ৪.৮৭ কোটি টাকা।

    * ২০২১, ২২ জানুয়ারি: মাসকাট থেকে আসা ফ্লাইটে ৭.২৯ কেজি সোনা জব্দ, মূল্য ৫ কোটি টাকা।

    * ২০১৯, ২০ এপ্রিল: ব্যাংকক থেকে আসা ফ্লাইটে ১৪ কেজি সোনা উদ্ধার, মূল্য ৭ কোটি টাকা।

    * ২০১৯, ৯ সেপ্টেম্বর: কেবিন ক্রু রোকেয়া শেখ মৌসুমী ১০ কেজি সোনাসহ গ্রেপ্তার, আদালতে স্বীকারোক্তি দেন।

    * ২০১৭, ১১ অক্টোবর: ৪.০৬ কেজি সোনা উদ্ধার, মূল্য ২.৩২ কোটি টাকা।

    * ২০১৭, ২৪ সেপ্টেম্বর: ৪.৬৬৫ কেজি সোনা উদ্ধার, মূল্য ২.৩ কোটি টাকা।

    কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, এয়ারলাইনসের কর্মীদের সম্পৃক্ততা ছাড়া এত বড় মাপের চোরাচালান সম্ভব নয়। তবে মূল হোতাদের শনাক্ত করা এখনো চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির এক সদস্য বলেন, এয়ারলাইনসের সহযোগিতা ছাড়া এ ধরনের চোরাচালান সম্ভব নয়। এফবিসিসিআইর সাবেক এক সহসভাপতি মনে করেন, মূল গডফাদারদের শনাক্ত করতে গভীর তদন্ত প্রয়োজন।

    এছাড়াও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের ডমেস্টিক কাউন্টারে যাত্রী প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। যাত্রী পারভীন সুলতানা জানান, গত ৮ অক্টোবর তাদের স্বামী বদরুল হুদা কক্সবাজারের টিকেট কাটতে গেলে ইউএস বাংলার কাউন্টারে এয়ারলাইনসের কর্মী শাহেদ, খালেদ শামসের নাম ব্যবহার করে অতিরিক্ত ২,০০০ টাকা নিয়ে টিকেট দেন। টিকেটে ‘গোল্ডেন স্কাই ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ এর নাম থাকলেও কোনো পে-সিল ছিল না। এ ঘটনায় ইউএস বাংলার জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম দায় অস্বীকার করলেও তদন্তের দাবি উঠেছে।

    ইউএস বাংলা গ্রুপের মালিক আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে অপরাধ আড়াল করতে মিডিয়া হাউজ কেনা এবং সাংবাদিকদের তুষ্ট করার অভিযোগ রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঢাকা পোস্টের সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে সাংবাদিকদের মালদ্বীপে বিনোদন ভ্রমণে পাঠানো হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন,এসব কারণে ইউএস বাংলার বিরুদ্ধে কোনো কলম চলে না।

    রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজারের ভুক্তভোগীরা ইউএস বাংলার ভূমি দখল, ভ্যাট ফাঁকি ও সোনা চোরাচালানের বিরুদ্ধে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তারা বলছেন, ইউএস বাংলা মগের মুল্লুকের মতো রাজত্ব চালাচ্ছে। আমাদের জমি বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসছে না।

    ইউএস বাংলা গ্রুপের এসব কার্যক্রম দেশের অর্থনীতি ও কৃষি খাতের জন্য হুমকি। ভ্যাট ফাঁকির মাধ্যমে সরকার বছরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। সোনা চোরাচালান দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিকে ক্ষুণ্ন করছে। কৃষি জমি দখলের ফলে কৃষকদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ছে। এছাড়া, সাংবাদিক নির্যাতন ও মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর হুমকি সৃষ্টি করছে।

    বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইউএস বাংলা গ্রুপের বিরুদ্ধে উঠে আসা অভিযোগগুলো দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি। প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ, নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে এই অপরাধগুলোর বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া এই প্রভাবশালী গ্রুপের অপকর্ম বন্ধ করা কঠিন হবে।

    এসব বিষয়ে জানতে ইউএস বাংলা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফলে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।


    গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন